– অরিজিৎ কুমার পাল
“কলকাতা”। স্বপ্ননগরী, সিটি অফ জয়— বাঙালির আত্মশ্লাঘার শহর। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীত, সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ তথ্য বলছে বাঙালির আপন নগরী বাঙালীহীন হওয়ার পথে এগোচ্ছে।
কি হোঁচট খেলেন? মনে করছেন কি অবাস্তব কষ্টকল্পনা! না। এটাই বাস্তব। একটু বিশদে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর পিছনে থাকার কারণগুলিকে।
ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হওয়ায় সেই সময় থেকেই সারা ভারতের অন্যতম গন্তব্য ছিল কলকাতা, স্বাধীনতার পরেও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি, দেশ ভাগ হওয়া সত্ত্বেও কলকাতা তখন ভারতের বিশেষত পূর্ব ভারতের ‘কর্ম নগরী’। দলে দলে বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তর প্রদেশ থেকে লোক আসতে থাকে। মাড়োয়ারি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, পার্সী সহ দক্ষিণ ভারতীয়রাও ভিড় জমায় ‘ব্যাবসায়িক’ স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। কিন্তু ধীরে ধীরে কলকাতায় শিল্প-বাণিজ্যের মন্দা শুরু হয়। কমতে থাকে বাইরে থেকে আসা লোকজন। কিন্তু উচ্চভিলাষী বাঙালি উল্টো দিকে ভালো ‘চাকরি’, ভালো মাইনের খোঁজে পাড়ি জমায় উত্তর কিংবা পশ্চিম ভারতে বা বিদেশে। কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ বনেদি বাড়ি গুলো ফাঁকা হতে থাকে, কেরিয়ারের খোঁজে কলকাতা ছাড়া সেই বাড়ির মালিকেরা সেগুলো তুলে দেয় প্রোমোটারদের হাতে, বনেদি বাড়ির জায়গায় মাথা তুলতে থাকে বড় বড় ‘ফ্ল্যাট বাড়ি’। যা কলকাতায় থাকা বাঙালির যারা বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায় এবং সেই একটি বনেদি বাঙালি যৌথ পরিবারের জায়গায় বসবাস করতে থাকে 10 থেকে 12 ঘর অবাঙালি পরিবার, নিজের বিশ্লেষণে জানান ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের পপুলেশন স্টাডিস সেন্টারের প্রধান প্রশান্ত পাঠক।
আইএসআই এর রিপোর্ট অনুসারে ১৯৯১ সালে শহরে বাঙালি ছিল ৬৪%। ১০ বছর পর তা কমে দাঁড়ায় ৫৫% এ। ২০১৩-২০১৪ সাল নাগাদ বাঙালির সংখ্যা এসে দাঁড়ায় মাত্র ৪৭%। আইএসআই এর বিজ্ঞানীরা কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি কর্পোরেশন এর 141 টি ওয়ার্ডে সার্ভে করে এই ভয়াবহ রিপোর্টটি তুলে ধরেছেন। এই দশকের জনগণনা না হওয়ায় এখনো অব্দি এবারের সার্ভে রিপোর্ট বানাতে পারেনি বিজ্ঞানী দল। তবে ৭-৮ বছর আগের পরিস্থিতি থেকে সহজেই এখনকার বাঙালির সংখ্যা আন্দাজ করা যায়। হয়তো এখন নিজের শহরেই বাঙালির সংখ্যা ৪০% এরও নিচে নেমে গিয়েছে। অন্যদিকে হিন্দিভাষীর সংখ্যা ৩০%, ইংরেজিভাষীর সংখ্যা ১০% এবং বাকি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ২০% এর আশেপাশে।
বিশেষজ্ঞ দল তাদের বিশ্লেষণে জানিয়েছে কলকাতার যারা আদি বাসিন্দা অর্থাৎ বাঙালিরা বেশিরভাগ ‘চাকুরীজীবী’ এবং তারা চাকরী করতেই পছন্দ করে। বিশেষজ্ঞ দল আরো জানিয়েছে যেহেতু বাঙালি চাকরী করতেই ভালবাসে তাই অবাঙালিরা সহজেই এখানে ব্যবসা তৈরি এবং প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ ব্যবসা বিমুখতা বা অর্থনীতির রাশ ছেড়ে দেওয়া বাঙালির সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছে তাঁরা।
বিভিন্ন ডেমোগ্রাফিক বিশেষজ্ঞদের মতে ৬০ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে কলকাতার আদি অঞ্চল শ্যামবাজার, বাগবাজার, আমহার্ষ্ট স্ট্রীট, বিডন স্ট্রিট তার গরিমা হারাচ্ছে উল্টোদিকে নিউ আলিপুর বালিগঞ্জ তথা সল্টলেক নতুন বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে এবং তা ও অবাঙালিদের কল্যাণে।
বাঙালি ও অবাঙালির এর এই ভারসাম্যহীনতায় প্রভাব পড়ছে সমস্ত দিকেই। অর্থনীতিতে বাঙালি নিয়ন্ত্রন হারিয়েছেই, সঙ্গে অবাঙালির সংখ্যা অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় কলকাতার বিভিন্ন অংশের রাজনৈতিক ক্ষমতার নীতি নির্ধারণ তাদের হাতেই চলে গিয়েছে। সঙ্গে বদলে যাচ্ছে সামাজিকতা থেকে সংস্কৃতির চিত্র।
বাঙালি নিজের পুরানো অবস্থান কি ফেরাতে পারবে এই কলকাতার বুকে? নাহলে যে জাত্যাভিমানী বাঙালির অন্যতম সেরা অহংকার কলকাতাই যে হাতছাড়া হয়ে যাবে সম্পূর্ণরূপে।